জার্নাল সাবমিশন সিস্টেম - অথার গাইড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা
জার্নালে পেপার সাবমিট করার সময় সাবমিশন সিস্টেম এবং অথার গাইডের মধ্যে পার্থক্য এবং করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত গাইড।
আমরা অনেকেই জানি যে কোনো জার্নালে পেপার সাবমিট করার আগে ওই জার্নালের manuscript সাবমিশনের নিয়মকানুন সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। সাধারণত প্রতিটি জার্নালের “অথার গাইড” বা “Instructions for Authors” নামক একটি বিভাগ থাকে, যেখান থেকে সাবমিশন সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, জার্নালগুলোর যে সাবমিশন সিস্টেম থাকে সেটি সম্পূর্ণ একটা আলাদা মাধ্যম এবং অনেক ক্ষেত্রে অথার গাইড-এর তথ্যের সাথে মিল নাও থাকতে পারে।
সাবমিশন সিস্টেম কী?
যদিও জার্নালের ওয়েবসাইটে সাবমিশন সিস্টেম-এর লিংক দেওয়া থাকে, কিন্তু সিস্টেমটি পুরোপুরি আলাদা একটি প্ল্যাটফর্মে পরিচালিত হয়। বর্তমানে বিভিন্ন জার্নাল বিভিন্ন সাবমিশন সিস্টেম ব্যবহার করে, যেমন:
- Editorial Manager (Aries Systems)
- ScholarOne Manuscripts (Clarivate)
- Elsevier Editorial System (EES)
- Open Journal Systems (OJS)
প্রতিটি সিস্টেমের নিজস্ব ইন্টারফেস এবং চাহিদা রয়েছে, যা অনেক সময় অথার গাইড-এ উল্লিখিত নির্দেশনা থেকে ভিন্ন হয়।
সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা
আপনি হয়তো ভাবছেন যে অথার গাইড পড়ে আপনি আপনার manuscript জার্নালে জমা দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। এরপর সাবমিশন সিস্টেম-এ লগইন করে ভাবছেন যে জমা দেওয়া শুরু করবেন, খুব বেশি সময় লাগবে না কারণ আপনি আগেই জার্নালের অথার গাইড থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন।
তাহলে আপনি প্রায় নিশ্চিতভাবেই ভুল করবেন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
জার্নালের অথার গাইড বা জমা দেওয়ার নীতিমালা এবং সাবমিশন সিস্টেম-এর নির্ধারিত চাহিদা প্রায়ই এক হয় না। আমি নিজে বহুবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি যে অথার গাইড পড়ে manuscript প্রস্তুত করেছি এবং জমা দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে সাবমিশন সিস্টেম-এ ঢুকেছি, কিন্তু দেখলাম যে আমি আসলে জমা দিতেই পারছি না।
কারণ সাবমিশন সিস্টেম-এ গিয়ে দেখা গেল:
- শব্দসীমা আলাদা
- অনুমোদিত পেজের সংখ্যা আলাদা
- চিত্রের সংখ্যা সীমা আলাদা
ফলে আমাকে আবার ফিরে গিয়ে manuscript সংশোধন করতে হয়েছে, চিত্র কমাতে হয়েছে কিংবা লেখা ছোট করতে হয়েছে - এবং এটা একবার দুইবার নয়, বহুবার ঘটেছে।
সাধারণ অসামঞ্জস্যতা
শব্দসীমা এবং পেজ সংখ্যা
উদাহরণস্বরূপ, অথার গাইড-এ হয়তো বলা আছে যে abstract-এর শব্দসীমা ২৫০ হতে পারবে এবং আপনি সে অনুযায়ী ২৪৫ শব্দের abstract তৈরি করেছেন। কিন্তু সাবমিশন সিস্টেম-এ ঢুকে দেখলেন যে শব্দসীমা ২৫০ নয়, শব্দসীমা ২০০। এখন আপনাকে ৪৫ শব্দ কমাতে হবে।
অথবা অথার গাইড-এ বলা আছে অনুমোদিত পেজের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩০, আপনি ২৮ পাতার manuscript বানিয়েছেন, কিন্তু সাবমিশন সিস্টেম বলছে সর্বোচ্চ ২৫ পাতা।
চিত্র এবং সারণি
আপনার ৮টি চিত্র আছে যা অথার গাইড অনুযায়ী ঠিক ছিল, কিন্তু সাবমিশন সিস্টেম বলছে সর্বোচ্চ ৬টি চিত্র। এই ধরনের অসামঞ্জস্যতা খুবই সাধারণ ঘটনা।
অনেক সময় আপনার এমন কোন চিত্র আছে যে চিত্রটি কয়েকটি ছোট চিত্র মিলে তৈরি করা (মিলিত চিত্র)। কিন্তু সাবমিশন সিস্টেম-এ গিয়ে দেখলেন যে তারা অনুমোদন করে শুধুমাত্র একটা চিত্র অর্থাৎ একটা ফাইল। সে ক্ষেত্রে আপনাকে আবার সব ছোট চিত্র মিলিয়ে একটা চিত্র তৈরি করে জমা দিতে হবে।
সংক্ষিপ্ত শিরোনাম
অনেক সময় প্রবন্ধের আরেকটা সংক্ষিপ্ত শিরোনাম (running title) দিতে হয় যেটা হয়তো আপনাকে ঠিক করতে একটু চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হবে এবং যেটার কথা অথার গাইড-এ হয়তো উল্লেখই ছিল না।
প্রতিষ্ঠান নাম সংক্রান্ত সমস্যা
আপনি জমা দেওয়া শুরু করতে বসলেন, আপনার কাছে লেখকদের প্রয়োজনীয় তথ্য যেমন তাদের ইমেইল আছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের তথ্য আছে। তবে প্রতিষ্ঠানের নাম লেখার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দেয়।
আপনি সেখানে শুধু নিজে থেকে প্রতিষ্ঠানের নাম লিখতে পারবেন না। বরং আপনাকে প্রতিষ্ঠানের প্রথম কিছু অক্ষর টাইপ করলে তাদের সিস্টেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু নাম প্রস্তাব করবে এবং সেখান থেকে আপনাকে আপনার প্রতিষ্ঠান বেছে নিতে হবে।
সমস্যা হলো যে অনেক সময় বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা স্বল্প-পরিচিত প্রতিষ্ঠান আপনি খুঁজে নাও পেতে পারেন। অর্থাৎ আপনার সহ-লেখকদের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যে নামগুলো আপনি হয়তো Editorial Manager কিংবা এরকম সফটওয়্যারে খুঁজে পাচ্ছেন না।
ORCID iD সমস্যা
আরো একটা বিষয় হলো ORCID iD। অনেক জার্নাল এখন ORCID iD সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, বিশেষ করে যোগাযোগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত লেখকের জন্য। আপনার কাছে যদি ORCID না থাকে তাহলে আপনাকে জমা দেওয়ার মাঝখানে গিয়ে ORCID তৈরি করতে হবে যা অপ্রত্যাশিত এবং সময়সাপেক্ষ হতে পারে।
Cover Letter এবং Declarations
Cover letter নিয়েও সমস্যা হতে পারে। অথার গাইড-এ হয়তো বলা আছে cover letter ঐচ্ছিক কিন্তু সাবমিশন সিস্টেম-এ গিয়ে দেখলেন এটা একটা বাধ্যতামূলক ঘর এবং আপনাকে অবশ্যই কিছু লিখতে হবে।
Declarations-এর ক্ষেত্রেও পার্থক্য দেখা যায়। অথার গাইড-এ হয়তো সাধারণ নির্দেশনা দেওয়া আছে, কিন্তু সাবমিশন সিস্টেম-এ গিয়ে দেখবেন:
- নির্দিষ্ট চিহ্নিত ঘর আছে
- বাধ্যতামূলক ঘর আছে
- প্রতিটি declaration আলাদাভাবে আপলোড করতে হতে পারে
- নির্দিষ্ট নমুনা ডাউনলোড করে পূরণ করতে হতে পারে
প্রস্তাবিত পর্যালোচক
হয়তো অথার গাইড-এ বলা ছিল ৩ জন প্রস্তাবিত পর্যালোচক দিতে পারেন, কিন্তু সাবমিশন সিস্টেম-এ দেখলেন সর্বনিম্ন ৫ জন লাগবে এবং প্রতিটি পর্যালোচকের জন্য শুধু নাম এবং ইমেইল নয়, বরং তাদের:
- সম্পূর্ণ যোগাযোগের তথ্য
- প্রতিষ্ঠান
- দেশ
- দক্ষতার ক্ষেত্র
- কেন তাদের প্রস্তাব করছেন সেই কারণ
ফাইল আপলোড সংক্রান্ত চাহিদা
অনেক জার্নাল বিভিন্ন উপাদান আলাদা আলাদা ফাইল হিসেবে আপলোড করতে বলে:
- শিরোনাম পাতা
- অথারের নাম ছাড়া manuscript (double-blind review-এর ক্ষেত্রে)
- চিত্র (আলাদা ফাইল হিসেবে)
- টেবিল/সারণি (আলাদা ফাইল হিসেবে অথবা manuscript-এ যুক্ত)
- Supplementary materials
- Cover letter
তাহলে কোনটা মানবেন?
আপনাকে যেহেতু সাবমিশন সিস্টেম-এর মাধ্যমেই জমা দিতে হবে, তাই সাবমিশন সিস্টেম-এ যেটা দেওয়া আছে, আপনাকে সেটাই মানতে হবে।
সমস্যা হলো সাবমিশন সিস্টেম-এর তথ্যগুলো আপনি জার্নালের ওয়েবসাইটে আগে থেকে খুঁজে পাবেন না। এটা শুধুমাত্র সাবমিশন সিস্টেম-এ ঢুকে লগইন করার পরে আপনি ধাপে ধাপে তথ্য দেখতে পারবেন।
আমার পরামর্শ
অথার গাইড পড়ুন, কিন্তু চূড়ান্ত মনে করবেন না
অথার গাইড-এর যে নির্দেশনা আছে সেটা মোটামুটি একটা সাধারণ ধারণা নেওয়ার জন্য পড়া, তবে বুঝে রাখা যে এর থেকে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
বিশেষ করে কতগুলো চিত্র থাকতে পারবে, চিত্রগুলোর ধরন কী, কতগুলো সারণি থাকতে পারবে, সারণির ধরন কী - এই ধরনের কারিগরি বিষয় অথার গাইড-এ যা আছে সেটা মোটামুটি নির্ভুল হয়।
সাবমিশন সিস্টেমই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ
শব্দসীমা, অনুমোদিত পেজের সংখ্যা, চিত্রের সংখ্যা সীমা, অক্ষরসীমা, অতিরিক্ত তথ্যের চাহিদা - এসব ক্ষেত্রে সাবমিশন সিস্টেম-ই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ।
পর্যাপ্ত সময় রাখুন
জমা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় রেখে শুরু করুন। কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা সময় হাতে রাখুন কারণ প্রথমবার জমা দিতে গেলে অনেক অপ্রত্যাশিত চাহিদা আসতে পারে।
প্রথমে পুরো প্রক্রিয়া দেখুন
সবচেয়ে ভালো হয় যদি সাবমিশন সিস্টেম-এ একবার ঢুকে পুরো প্রক্রিয়াটা একবার দেখে নেন কোন কোন ধাপে কী কী তথ্য লাগবে, তাহলে আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারবেন।
অনেক সাবমিশন সিস্টেম-এ “খসড়া হিসেবে সংরক্ষণ” বিকল্প থাকে, সেটা ব্যবহার করে আস্তে আস্তে সব তথ্য পূরণ করতে পারেন।
কিছু সাধারণ সমস্যা এবং করণীয়
প্রতিষ্ঠান খুঁজে না পেলে
প্রথমে প্রতিষ্ঠানের বিকল্প নাম, ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষা উভয় নাম চেষ্টা করে দেখুন। যদি একেবারেই না পান তাহলে editorial office-এ ইমেইল করে জানান। কিছু সিস্টেমে “Other” বা “Not listed” বিকল্প থাকে যেটা ব্যবহার করতে পারেন।
ফাইল আপলোড না হলে
- প্রথমে ফাইলের আকার কমানোর চেষ্টা করুন, সংকুচিত করুন
- ফাইলের ধরন পরিবর্তন করে দেখুন
- ফাইলের নাম থেকে বিশেষ চিহ্ন এবং ফাঁকা জায়গা সরিয়ে ফেলুন
- ভিন্ন ব্রাউজার চেষ্টা করুন
- ইন্টারনেট সংযোগ ভালো আছে কিনা যাচাই করুন
ORCID না থাকলে
orcid.org থেকে বিনামূল্যে তৈরি করে নিন, এটা মাত্র ৫ মিনিটের কাজ।
গুরুত্বপূর্ণ: প্রতিটি ব্যক্তির শুধুমাত্র একটিমাত্র ORCID iD থাকা উচিত। একাধিক ORCID iD তৈরি করবেন না, কারণ এতে আপনার প্রকাশনা রেকর্ড বিভক্ত হয়ে যাবে এবং সনাক্তকরণে সমস্যা সৃষ্টি হবে।
আপনার সব সহ-লেখকদের জন্যও ORCID তৈরি করে দিতে পারেন অথবা তাদের বলতে পারেন তৈরি করে নিতে। তবে নিশ্চিত করুন যে তাদের আগে থেকে ORCID আছে কিনা, যাতে ডুপ্লিকেট তৈরি না হয়।
Declarations নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে
- Editorial office থেকে নমুনা চেয়ে নিন
- একই রকম প্রকাশিত গবেষণাপত্র দেখতে পারেন যে তারা কীভাবে declarations লিখেছে
- আপনার প্রতিষ্ঠানের গবেষণা কার্যালয় বা নৈতিকতা কমিটির সাহায্যও নিতে পারেন
শেষ কথা
জার্নালে manuscript জমা দেওয়া একটি বহু-পদক্ষেপ বিশিষ্ট প্রক্রিয়া যেখানে শুধুমাত্র ভালো গবেষণা থাকলেই হয় না, বরং সঠিক বিন্যাস, সম্পূর্ণ declarations এবং সাবমিশন সিস্টেম-এর চাহিদা মেনে চলাও অত্যন্ত জরুরি।
মনে রাখবেন যে অথার গাইড একটি সাধারণ নির্দেশনা মাত্র এবং সাবমিশন সিস্টেম-ই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। Declarations সঠিকভাবে করা না হলে আপনার manuscript editorial office থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যেতে পারে এবং peer review-তে যাওয়ার আগেই ফিরিয়ে দেওয়া হতে পারে।
এই নির্দেশনাগুলো মনে রাখলে আপনার manuscript জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া অনেক সহজ এবং সফল হবে। প্রথমবার সাবমিশনের আগে সিস্টেমটি ভালোভাবে দেখে নিন এবং পর্যাপ্ত সময় হাতে রাখুন!